‘ঢাক-ঢোল-তবলা মেরামত করে এখন আর সংসার চলে না’
আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে মাদারীপুরে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। তাই হারমোনিয়াম-তবলা তৈরিতে জড়িতদের সেই সুদিন আর নেই। কেউ কেউ কোনোমতে পারিবারিক পেশা আগলে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ পেশা বদলে অন্য কাজ করছেন।

এখন আগের মতো ঢাক-ঢোলের তেমন চাহিদা এখন আর নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ঢাক, ঢোল, তবলাসহ দেশীয় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র।
মাদারীপুর পৌ শহরের পানিছত্র এলাকার বাসিন্দা পল্টু কবিরাজ। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে আসছেন ৫০ বছর বয়সী পল্টু কবিরাজ। ছোটবেলা থেকেই টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার কেডারপুর এলাকায় তাদের পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তিনি। বর্তমানে মাদারীপুর শহরের পানিছত্র এলাকায় মাদারীপুর-শরিয়াতপুর মহাসড়কের পাশে বাদ্যযন্ত্রের দোকান তার। উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসে এসবের চাহিদা তেমন না থাকায় হতাশ তিনি।
এই কারিগর আক্ষেপ করে বলেন, ২০ বছর আগেও হারমোনিয়াম, তবলার বেচা বিক্রি বেশ ভালো ছিল। তখন প্রতিদিনই কাজের অর্ডার থাকতো। ক্রেতারা রেডিমেটের পাশাপাশি অর্ডার দিয়েও এসব বাদ্যযন্ত্র কিনতেন। কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। এখন দখল নিয়েছে ইলেকট্রিক গিটার, কিবোর্ড, পিয়ানো, ড্রামসেট, ভায়োলিনের মতো ভিনদেশি বাদ্যযন্ত্র। মহামারী করোনার আগেও মোটামুটি বেচাকেনা ভালো ছিল। কিন্তু করোনা আর ডিজিটাল ইলেকট্রনিকের ফলে এ শিল্পে আর সুদিন নেই। কাজ-কর্মও কমে গেছে। অনেক কারিগর টিকে থাকতে না পেরে জীবিকানির্বাহের জন্য অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, দুবেলা-দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে এখানে পড়ে আছি। কিন্তু বর্তমান ব্যবসার অবস্থা এতই খারাপ হয়েছে, বাসা আর দোকানভাড়া দিয়ে কোনো রকমে পেটে-ভাতে টিকে আছি। কোনো মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পাই। আবার কোনো কোনো মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পাই এ দিয়ে চলতে ভীষণ কষ্ট হয়। সরকার যদি আমাদের দিকে তাকাত তাহলে আমরা এই ব্যবসাটা ধরে রাখতে পারতাম।
গিটার তবলার কারিগরি পল্টু কবিরাজের স্ত্রী সবিতা রানি কবিরাজ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ৩০ বছরের পুরোনো। এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। এক সময়ে আমার শ্বশুর করতেন। এখন আমার স্বামী করে। তাদের বাপ দাদার আমলের এ ব্যবসা। এখন কাজকর্ম অনেক কমে গেছে। বাবা-দাদার পুরোনো পেশা তাই ছাড়তে পারি না। কোনোমতে আঁকড়ে ধরে টিকে আছি।
দেশীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগর দুলাল চন্দ্র মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪৫ বছরের মতো এ পেশায় জড়িত। গান-বাজনা কমে গেছে। আগের মতো গানও নেই। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যাবহারও কম। কোনোমতে টিকে আছি। দীর্ঘদিনের এ পেশায় সংসারও চলে কোনোরকমে।
স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই পল্টু কবিরাজকে দেখে আসছি সে এই গিটার, তবলা, ঢোলএগুলো মেরামত করে আসছে। আগে এগুলো দেখতাম অনেক ভালো চলতো। কিন্তু বর্তমানে তার এদিকে কোনো কাস্টমার দেখি না। এখন বর্তমানে তার যে বেচাকেনা এতে চলতে খুবই কষ্ট হয়।
মাদারীপুর উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী সংগঠনের তবলা প্রশিক্ষক সান্ত কুমার বলেন, এখনকার নতুন প্রজন্ম এত কষ্ট করে গান-বাজনা শিখতে আগ্রহী নয়। সংগীতে হারমোনিয়াম-তবলা, ঢোল-খোল, বাঁশির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে। তুলনামূলক সহজ হওয়ায় বর্তমান প্রজন্ম ইলেকট্রিক বাদ্যযন্ত্রের দিকে বেশি ঝুঁকছে। দেশীয় সংস্কৃতি বাঁচাতে যথাযথভাবে এই শিল্পের সংরক্ষণের দাবি আমাদের মতো সাংস্কৃতিক কর্মীদের।
মাদারীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্য প্রশিক্ষক আ জ ম কামাল বলেন, আগে আমরা মঞ্চ নাটক করলে সেখানে ঢোল তবলার বাদ্য বাজিয়ে নাটকের মোহরা করতাম। এখন আধুনিক ছোঁয়ার কারণে সেই যুগ পাল্টে গেছে। এখন আর মানুষ পরিশ্রম বা কষ্ট করতে চায় না।
ইতিহাসবীদ সুবল বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে পুরনো বাদ্যযন্ত্রগুলো। বর্তমানে যে কয়জন এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন, তারাও আর বেশি দিন থাকছেন না। ১০-২০ বছর পর হয়তো শোনা যাবে, এ পেশা বলতে কিছুই নেই।
এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মারুফুর রশিদ খান বলেন, স্থানীয় বিসিকের মাধ্যমে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হবে।