Search

মোবাইল না দিলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে সন্তানেরা

‘ছোটবেলা থেকে তার সন্তানের কোনো চাহিদা ছিল না, কারো কথা অমান্য করত না। আর এখন তার স্মার্টফোন ছাড়া চলেই না। এমন কি স্মার্টফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে বললে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করে। রাতে কয়েক ঘণ্টা ঘুমায়, সকালে উঠে দিনের বাকিটা অংশ সে ব্যস্ত থাকে স্মার্টফোন নিয়ে। খাবার খেতে বসলেও ফোন ছাড়া খেতে চায় না। স্কুলে পড়ার চাপ কম তাই বাড়তি তাড়া দেওয়া যায় না, আবার তার এমন পরিবর্তনও মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।’


মোবাইল না দিলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে সন্তানেরা

নিজের সন্তানের মোবাইল ফোনে গেইমের আসক্তির কথা জানান ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। 

শুধু একজন নয়, ফেনী শহর ও উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য কিশোর-তরুণরা অনলাইন গেমসে আসক্ত। আর এই আসক্তির মাত্রা বেড়েছে মারাত্মক হারে। তাদের কখনো দলবদ্ধভাবে, কখনো নিজ রুমে একা বসে নানা ধরনের গেমস খেলতে দেখা যায়। তালিকায় রয়েছে মারামারিসহ বিভিন্ন বিভীষিকাময় গেমস।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনা মহামারীর দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে কিশোর ও তরুণদের দৈনন্দিন জীবনে। অনলাইন ক্লাস করতে তাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন অভিভাবকরা। কিন্তু পড়াশোনার চাপ না থাকায় তখনই তাদের বেশিরভাগ সময় কাটত অনলাইন জগতে। অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের গেমসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দিনরাত মগ্ন হয়ে পড়েছে তারা। ভুলে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আসক্তির পরিমাণ এতই বেড়েছে যা তাদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন তৈরি করেছে। এতে করে যেমন তাদের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটছে, তেমনি আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে।

পরশুরাম উপজেলার মির্জানগরের বীরচন্দ্র নগর গ্রামের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক  বলেন, আমি পেশায় একজন কৃষক হলেও করোনাকালে সন্তানের অনলাইন ক্লাসের জন্য সাড়ে ১৫ হাজার টাকায় ফোন কিনে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে এখন প্রতিদিন মোবাইল গেমস খেলে। প্রতি মাসে ইন্টারনেট ও গেমস বাবদ দেড় হাজার টাকার মতো খরচ হয়।

আজিজুল হক নামে অন্য অভিভাবক বলেন, আমার ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া ছোট ভাই এখন গেমসে আসক্ত হয়ে ঠিকমতো খাওয়া-গোসল পর্যন্ত করছে না। কোনো কিছু বললেই সে অল্পতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, খারাপ আচরণ শুরু করে। সে আগে এমন ছিল না।

বন্ধুদের দেখাদেখি গেমস খেলতে শুরু করে আরিফুর রহমান নামে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হলে সে জানায়, শুরুর দিকে ফ্রি-ফায়ার গেমস ভালো না লাগলেও এখন সে এতে আসক্ত হয়ে গেছে। এখন গেমস না খেললে তার কিছু ভালো লাগে না। সব কিছু অসহ্যকর মনে হয়। 

একইভাবে নাহিদ নামে গেমসে আসক্ত অন্য এক শিক্ষার্থী জানায়, সে আগে এসব গেমস সম্পর্কে কিছু জানতো না। এখন সে নিয়মিত এসব গেমস খেলে। মাঝে মধ্যে গেমস খেলতে না পারলে মুঠোফোন ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা হয় তার। 

জাহিদুল ইসলাম নামে এক কিশোর বলেন, আশপাশের খেলাধুলার জন্য তেমন সুযোগ নেই। ঘরে একা একা কতদিন থাকা যায়। এজন্যই গেমস খেলে সময় কাটাচ্ছি। 

শহরের ডাক্তারপাড়ার মো. সোয়াইব নামে কলেজ পড়ুয়া এক গেইমার বলেন, ফেনীতে নতুন গেইমারদের প্রায় ৭০ শতাংশই ফ্রি ফায়ার ও পাবজি নামক দুটো জনপ্রিয় গেম খেলে। অন্যান্য গেইমের খেলোয়াড় তুলনামূলক কম।

নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক সৌহার্দ্য

অনলাইন গেমস খেলাকে কেন্দ্র করে বাড়ছে পারিবারিক কলহ, ফলে নষ্ট হচ্ছে পারস্পরিক সৌহর্দ্য। অভিভাবকদের দেওয়া তথ্য মতে, গেম খেলায় আসক্ত হয়ে সন্তানরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ, বাবা-মার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, অল্পতেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়া, ইন্টারনেট না থাকলে অথবা মোবাইল বা কম্পিউটারের চার্জ ফুরিয়ে গেলে অস্থির ও অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।

শহরের উকিল পাড়ার ৯ম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, করোনার আগেও ছেলে বাসার কাজে সহযোগিতা করতো। অবসর সময়ে বাসায় ছোট ভাইকে নিয়ে খেলাধুলাে করতো। কিন্তু এখন তাকে গেমস খেলার সময়ে কোনো কিছু বললে রেগে যায়। 

 টিপু নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ছেলের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে পরিবারে নিজেদের মধ্যে এখন প্রায় ঝগড়া লেগেই থাকে।

হিংস্র হচ্ছে মনোভাব

গত ২২ জুলাই ফেনীর পরশুরামের বীরচন্দ্র নগর গ্রামে ফ্রি-ফায়ার নামক একটি গেম খেলাকে কেন্দ্র করে জাহিদ ও সাগর নামে দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মধ্যে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এতে এক পর্যায়ে দুজন মারামারিতে লিপ্ত হয়। আহত হয় সাগর।

সাগর  জানান, ফ্রি-ফায়ার খেলার সময়ে একটি বিষয়ে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মারামারি হলে তার মাথায় ও মুখে আঘাত লাগে। পরবর্তী বিষয়টি মিটমাট হয়ে যাবার পর এখন তারা দুজন আবার একত্রিত হয়ে গেমস খেলছে। 

গেম খেলে বিনোদন নিতে গিয়ে ধীরে ধীরে হিংস্র মনোভাব তৈরি হচ্ছে গেইমারদের মধ্যে। যেকোনো ছোট বিষয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়াতে দ্বিধাবোধ করছে না তারা। 

আরিফুর রহমান নামে এক পাবজি গেইমার বলেন, গেইমের সঙ্গে বাস্তবতা চিন্তা করলে অন্যরকম অনুভূতি লাগে।

গেমস আসক্তিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এটি কিশোর ও তরুণদের বিকাশে বড় বিপর্যয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

কিশোর ও তরুণদের আসক্তির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ফেনী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল বলেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। বাচ্চাদের সময় দিতে হবে। তারা যেন খেলাধুলা করতে পারে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া বয়স অনুযায়ী সন্তানদের শাসন ও ধর্মীয় অনুশাসন চর্চায় অভিভাবকদের সচেষ্ট হতে বলেন এ শিক্ষাবিদ।

আসক্তির প্রবণতা বাড়ার কারণ হিসেবে অধ্যক্ষ বিমল কান্তি পাল বলেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির অতিমাত্রার ব্যবহার এবং যথোপযুক্ত ব্যবহার না করার কারণে সন্তানরা এসব গেমসে আসক্ত হচ্ছে। পূর্বে সন্তান কান্নাকাটি করলে বিভিন্ন উপায়ে শান্ত করার চেষ্টা করা হত। কিন্তু এখন সহজেই সন্তানকে শান্ত রাখতে মোবাইল ফোনসহ নানা যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দেন ব্যস্ত মা-বাবারা। তারা নিজেরাও মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকেন। 

বিমল কান্তি পাল আরও বলেন, বর্তমানে মা-বাবারা নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে নিজের চোখের সামনে সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন-ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তি অনুভব করেন। যা শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেটে আসক্ত করে ফেলে। বাবা-মা নিজেরাও যদি সারাদিন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মগ্ন থাকেন তাহলেও সন্তানের মধ্যে আসক্তির প্রবণতা বেড়ে যায়।