ডাক্তার হয়ে কৃষক বাবার যোগ্য সন্তান হতে চান যূথি
প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের কৃষকের মেয়ে যূথি। স্কুলে যাওয়ার সময় মেঠোপথের দুই পাশের ফসলী মাঠে রোদ-বৃষ্টিতে ভেজা জীর্ণ পোশাকের পা ফাঁটা মানুষগুলোকে দেখে বাবাকে যেন আরও বেশি অনুধাবন করত সে। রোদ-বৃষ্টিতে ভেজা বাবার মুখে হাসি ফোটাতে যূথি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বপ্ন দেখেছিল চিকিৎসক হওয়ার। অবশেষে বাবার পরিশ্রমকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে যূথি।

মেয়ের স্বপ্ন পূরণে সকল কষ্ট ভুলে হাসি ফুটেছে কৃষক বাবার মুখে। যূথির স্বপ্ন এখন সুচিকিৎসক হয়ে বাবার মতো কৃষকসহ সবার চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের সখিপুর থানার চরকুমারিয়ার লালু বেপারী কান্দি গ্রামের কৃষক হাবিব মালত ও গৃহিণী হাফেজা বেগম দম্পত্তির মেয়ে উম্মে হানী যূথি।
স্থানীয় ও যূথির পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে উম্মে হানী যূথি মেজ। ছোট বেলা থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থী যূথি ছবি আঁকতে ভীষণ পছন্দ করত। তার আঁকা ছবিতে কৃষকের ফসল ফলানো, প্রাকৃতিক নৈসর্গ ফুটে উঠত। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে চরকুমারিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করে যূথি। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ-৫ পায় সে। এছাড়া স্কুল-কলেজ জীবনে বিভিন্ন শিক্ষামূলক বৃত্তি পেয়েও কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছে যূথি। ছোট বেলা থেকে কৃষক বাবা-মায়ের কষ্ট দেখে মনে দাগ কাটত তার। রোদ-বৃষ্টি ভেজা বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। যূথির স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তার মা-বাবা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তবে একটু সময় পেলেই পড়াশোনার ফাঁকে যূথি তার বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতা করত। মা-বাবার কঠোর পরিশ্রম অনুপ্রেরণা দিয়েছে তাকে। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে তেজগাঁও কলেজ কেন্দ্র থেকে অংশ নিয়ে ৭০.৫০ নম্বর পেয়ে ৩ হাজার ১৫৪ তম স্থান দখল করে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন যূথি। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তার শিক্ষক, সহপাঠী ও স্বজনরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। দলে দলে যূথির বাড়িতে আসছেন, তাকে দেখতে।
যূথি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবে এমন খবর শুনে তাকে দেখতে এসেছেন প্রতিবেশী রাবেয়া সুলতানা। তিনি বলেন, যূথি খুব মেধাবী মেয়ে। ও মেডিকেলে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে, এমন খবরে আমরা আনন্দিত। যূথি ডাক্তার হয়ে আমাদের সেবা করবে, এই প্রত্যয়ে আমরা আরও বেশি আনন্দিত।
আরেকজন প্রতিবেশী গৃহবধু আমেনা বেগম। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে যূথি। ওর বাবা-মা অনেক কষ্ট করেছে, ওর পড়াশোনা করানোর জন্য। যূথি মেডিকেলে ভর্তি হতে পারবে বলে তার বাবা-মায়ের কষ্ট সফল হয়েছে। যূথির ভালো ফলাফলে আমরা আনন্দিত।
যূথি বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাবা অনেক কষ্ট করে কৃষি কাজ করেন। এসব দেখে আমার মনে হতো কৃষক বাবার যোগ্য যেন আমি হই। আমি যেন তার ঘামের কষ্টের মর্ম বুঝতে পারি। আমার সাফল্যের মূল হাতিয়ার হলো আমার বাবা-মা ও তাদের পরিশ্রম। সপ্তম শ্রেণি থেকে আমি মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। ভর্তি পরীক্ষার সময়টাতে হঠাৎ করেই আমার বিভিন্ন বইপত্রের প্রয়োজন পড়ত। তখন বাবা টাকা দিত, মা হাস মুরগীর ডিম বিক্রি করে টাকা দিত। যখন ভেঙে পড়তাম, তখন আমার মা বাবা, শিক্ষক, ভাই বোন সবাই আমাকে প্রেরণা দিত। রাতে ঘুম আসলে মনে হতো আমাদের সুখের জন্য বাবা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ করেন, আমি যদি ঘুমিয়ে যাই তাহলে তার পরিশ্রমকে মূল্যায়ন করা হবে না। তাই কষ্ট হলেও পড়াশোনা করতাম। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন, আমি যেন সুচিকিৎসক হয়ে বাবার মতো যেসব কৃষক রয়েছেন, তাদেরসহ সবাইকে ভালো সেবা দিতে পারি।
যূথির মা হাফেজা বেগম বলেন, কৃষক পরিবার হলেও মেয়েকে আমি যথেষ্ট সময় ও সুযোগ দিয়েছি। দেখা গেছে, ভোর ৬টার সময় যূথিকে স্কুলে যেতে হয়েছে। সারাদিন কাজ করার পরেও ফজরের সময় উঠে গরম ভাত রেঁধে একটি ডিম ভেজে ওকে খেতে দিয়েছি। কারণ আমি জানি ক্ষুধা লাগলে পড়তে ইচ্ছে করবে না ওর। বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি মেয়ের দিকেও খেয়াল রাখতাম, পড়াশোনা করছে কি না? আদর, শাসন, উৎসাহ আর অনুপ্রেরণাই যূথিকে এই সাফল্য এনে দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, পড়াশোনা শেষে আমার মেয়ে ডাক্তার হবে। যূথি যেন ডাক্তার হয়ে গ্রামের গরিব মানুষসহ সকলের সেবা করতে পারে সেই দোয়া চাই।
যূথির কৃষক বাবা হাবিব মালত বলেন, কৃষিকাজ করে মেয়ের পড়াশোনার খরচ বহন করতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে এখন আমার কোনো কষ্ট নেই। যূথি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে, এই খবর পাওয়ার পরে আমি সব কষ্ট ভুলে গেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমার মেয়ে যেন পড়াশোনা শেষ করে এলাকার সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে পারে।
যূথির শিক্ষক জসিম উদ্দিন চরকুমারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যূথি বরাবরই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। স্কুলের পরীক্ষায় সে প্রথম স্থান দখল করত। এবছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে আমি যূথিকে শুভেচ্ছা জানাই, দোয়া করি। যূথি আমার স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আশা করছি, ডাক্তার হয়ে যূথি দেশের জন্য কাজ করবে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির মোল্যা বলেন, এবছর চরকুমারিয়া স্কুলের শিক্ষার্থী যূথি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে। আমি আনন্দচিত্তে যূথিকেসহ স্কুলের শিক্ষকদের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাই। যূথি সাধারণ কৃষক পরিবারের মেয়ে। যাদের বাবা মা ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি আন্তরিক, তাদের সন্তানরা সব সময় ভালো করে। যূথির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছি। সে যেন চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে পারে।