কপোতাক্ষের ভাঙনে নিঃস্ব এক গ্রামের ২৫০ পরিবার
‘২০০৯ সালে বড় দুর্যোগের পর থেইকে ভাঙন শুরু হয়। তা যেন আর থামতি চায় না। গ্রামের মানুষ কত চিষ্টাই না করলো। ধানের জমি, বাস্তুভিটে ঠেকাতি জান-প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তবুও শেষ রক্ষে হয়নি কারও। ধানি জমি তো সব আগেই গেছে। এখন প্রত্যেক বছর বসতভিটে সরাতি হচ্ছে। এভাবে ১৩ বছরে ১০ বার সরাইছি, আর জায়গা নেই। এবার ভাঙলি এলাকা ছাড়তি হবে।’

কপোতাক্ষ নদের পাড়ে বসে এভাবে নিজেদের দুর্ভোগের কথা বলছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের আফছার মোড়ল (৮০)। পেছনে দাঁড়িয়ে ছেলে খোকন মোড়ল দেখাচ্ছিলেন নদের ওপারের চরে এখন তাদের বসতভিটা ও ফসলি জমি জেগে উঠেছে। ১৩ বছরে ২০ বিঘা ফসলি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে এখন নিঃস্ব পরিবারটি।
জানা গেছে, আফছার মোড়লের মতো গ্রামের অন্তত ২৫০টি পরিবারের একই অবস্থা। কপোতাক্ষের ভাঙনে নিশ্চিহ্নের পথে গ্রামটি। স্থানীয়দের ভাষ্য, ১৩ বছরে নদের পেটে চলে গেছে প্রায় ৭০০ বিঘা ফসলি জমি ও বসতভিটা। আগে মূল গ্রামটি যেখানে ছিল, সেখানে এখন প্রবাহিত হচ্ছে নদ। কিছু অংশে চর জাগলেও ওপারের বাসিন্দাদের দখলে চলে গেছে তা।
কপোতাক্ষের পূর্ব পাড়ের দশহালিয়া গ্রাম খুলনা জেলায়। আর পশ্চিম পাড় সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে পড়েছে। সীমানা জটিলতার কারণে চাইলেও জমির দখল পাচ্ছেন না মূল মালিকরা। এ নিয়ে আদালতে মামলাও ঝুলে রয়েছে দীর্ঘদিন। ভাঙন রোধে সরকারি বরাদ্দ এলেও ঠিকমতো কাজ হয় না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
কপোতাক্ষের ভাঙনে পরিবারের ৫০ বিঘা জমির মধ্যে এক বিঘা অবশিষ্ট আছে বলে জানান গ্রামটির বাসিন্দা আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, জমিটিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন তারা। সেটুকুও যাওয়ার পথে।
ময়নুদ্দীন মোল্যা, আমীর আলী, আয়নুদ্দীন, দীনবন্ধু, বসন্ত কুমারসহ অনেকে জানান, ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে গ্রামের গৃহস্থ পরিবারগুলোর। কপোতাক্ষের অব্যাহত ভাঙনে তাদের ধানের জমি, ঘরবাড়ি, মসজিদ, মন্দির সব চলে গেছে নদীতে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা জমি কিনে বাড়ি করেছেন। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা ভাঙনকবলিত স্থানে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন।
২০০০ সালের দিকে নদে ভাঙন শুরু হলেও ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল। দু-এক বিঘা ফসলি জমি ভাঙলেও স্বেচ্ছাশ্রমে তা মেরামত করা হতো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যায় বলে জানান গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য কামাল হোসেন। তাঁর অভিযোগ, ভাঙন ঠেকাতে প্রতি বছর সরকারি বরাদ্দ এলেও পরিকল্পনামাফিক কাজ না হওয়ায় টেকসই হয়নি। ফলে গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী সুমন মিয়া বলেন, নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে দশহালিয়া গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাঙন থেকে তাদের রক্ষায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আরও ১১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এসব কাজ শেষ হলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন গ্রামের মানুষ।
উপকূলীয় উপজেলাটি ভাঙনপ্রবণ জানিয়ে ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) বি এম তারিকুজ্জামান বলেন, এ গ্রামের মতো অনেক স্থানের মানুষ নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর স্থায়ী সমাধানে প্রায় ১১শ কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি শেষ হলে স্বস্তি ফিরবে এলাকায়।