কুমিল্লায় ঘরবাড়ি ও ফসল হারিয়ে মানুষের হাহাকার
বন্যাকবলিত কুমল্লা জেলায় পানিবন্দী হয়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। তলিয়ে গেছে জেলার প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। বাড়িঘর ও কৃষির বিপুল ক্ষয়ক্ষতিতে হাহাকার করছেন কৃসকরা।

জানা যায়, এক সপ্তাহের টানা ভারী বর্ষণের কারণে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের চাপে কুমিল্লার গোমতী ও সালদা নদী বাঁধ ভেঙে দুই উপজেলা বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়ার অন্তত ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়। এ ছাড়া বন্যাকবলিত ফেনীর পাশের উপজেলা চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ তলিয়েছে পানিতে। আর তাতে পানিবন্দি হয় আরও চার লাখ মানুষ।
এ অঞ্চলের বসবাসরত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশাগুলোর মধ্যে কৃষিকাজ ও মৎস আহরণ অন্যতম। বন্যার পানিতে কৃষিজমি মাছের ফিশারিগুলো তলিয়ে যাওয়ায় তাদের ভবিষ্যতে খাদ্য ও অর্থ সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিপুল লোকশানে পড়েন খামারিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বন্যার পানিতে তলিয়েছে জেলার প্রায় ৬৪ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। এতে কুমিল্লার প্রান্তিক কৃষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নদী তীরবর্তী উপজেলাগুলোতে কৃষিই ছিল কোনো কোনো পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন। বন্যার পানিতে সেই কৃষিজমি তলিয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক পরিবার।
এদিকে, বন্যার পানিতে সবকিছু হারানো দুর্গম অঞ্চলের দুর্গত মানুষদের অনেকেই এখনো প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়নি বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়। তাছাড়া দুর্গম অঞ্চকগুলোর কোনো কোনোটিতে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ বিতরণও হয়নি।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গোমতী নদীর পানি সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দুপুর আড়াইটায় বিপদসীমা থেকে ৭ সে.মি. উপরে ছিল। এখনো তলিয়ে আছে জেলার হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার জুরাইন, খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজার, কিং বাজেহুরা, মিথিলাপুর, শিকারপুর, মহিষমারা, ইছাপুরা, পয়াত, গাজীপুর, কণ্ঠনগর, মাওরা, গোপীনাথপুর, জগৎপুর ও গোসাইপুর, বেড়াজাল, শ্যামপুর, গোবিন্দপুরসহ অনেক এলাকা তলিয়ে আছে পানিতে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া, চান্দলা ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নানকরা, ফালগুনকরা, আটগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট উত্তর, রায়কোট দক্ষিণ, বাঙ্গড্ডাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন তলিয়ে গেছে।
গত ২২ আগস্ট রাতে গোমতীর উত্তর পাশের বুরবুরিয়া বাঁধ এবং পরে সালদা নদীর দক্ষিণ পাশের একটি বাঁধ ভেঙে যায় পানির তোড়ে। আমন ও আউশ ধানসহ নানা শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল এখন পানির নিচে। অনেক কৃষকের লাউ, ঢেঁড়স, ঝিঙ্গা, মূলা, লাল শাকসহ আরো বিভিন্ন জাতের সবজি পানিতে ডুবে গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানির নিচে থাকায় ফসল আর রক্ষা করা যাবে না বলে জানান এই অঞ্চলের কৃষকেরা।
সব হারিয়ে কৃষকরা হা-হুতাশ করছেন। তারা বলছেন, ঘর গেল, ক্ষেত-খামারের ফসলও গেল! তাদের আর বাঁচার মতো কিছুই রইল না।
এদিকে, নদীর চরাঞ্চলের কৃষকরাও পড়েছেন বিপাকে। চর ডুবে যাওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সেখানে।
বুড়িচংয়ের জুরাইন এলাকার কৃষক হানিফ মিয়া বলেন, এ বছর বৃষ্টি ভালো হওয়ায় ফসলও ভালো হবে ধারণা করেছিলেন। পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ, আর তিন বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের শাকসবজি করেছিলেন। সবই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
হানিফ মিয়া বলেন, ‘এত দিন পানির নিচে ডুবে আছে ফসল-শাকসবজি। এখন আর কিছুই টিকবে না। খী খেয়ে বাঁচব, সংসার চলবে কী করে!’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আইয়ুব মাহমুদ বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যার পানিতে জেলার প্রায় ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। সাধারণত পানির নিচে চার-পাঁচ দিন থাকলেই বীজতলা, আমন ও আউশ ধান নষ্ট হয়ে যায়। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, পানিতে তলিয়ে যাওয়া কোনো ফসল আর টিকবে না। তবে যত দ্রুত পানি কমবে, ততই কৃষকরা ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।’
এদিকে, কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালীউজ্জামান জানান, লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় গোমতী নদীর পানি এখন বিপৎসীমা থেকে ৭ সেন্টিমিটার উপরে রয়েছে। সাধারণত গোমতী নদীর পানির মূল লেভেল ১১.৩ মিটার ধরা হয়। এই লেভেলে পানি নেমে এলে লোকালয়ে আর পানি ঢুকবে না।
জেলা আবহাওয়া কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুর রহমান জানান, তাদের একটি ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেওয়া ছিল, সেটি এখন আর নেই। তবে, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।